‘লোকাল’ এবং ‘চালান’ (থিয়েটারের দুই প্রজাতি)
‘লোকাল’ এবং ‘চালান’
(থিয়েটারের দুই প্রজাতি)
রুদ্র প্রসাদ চক্রবর্তী
পরিচালক, আসানসোল চর্যাপদ
এই লেখা উৎসর্গ করা
পশ্চিমবঙ্গের বাইশটি জেলার বহু নাট্য তথা অন্যান্য শিল্পীদের। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন
বাইশটি জেলা, কারণ তেইশ নম্বরটির অধিকাংশ শিল্পী এবং মিডিয়া ওটিকে জেলা মনেই করেন
না। দেখুন, আমাদের রাজ্যে মূলত
শিল্পীদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়; কলকাতার শিল্পী, দুই স্থানীয় (পড়ুন লোকাল
আর্টিস্ট)। মাছের ক্ষেত্রে ‘লোকাল’-এর দাম থাকলেও শিল্পের ক্ষেত্রে সম্মান ও অর্থে
‘চালান’-এর দাম বেশী। তবে সেই চালান রাজ্যের বাকি বাইশটি জেলার হলে চলবে না। হতে
হবে সত্যজিৎ-এর মহানগর আর ঋত্বিকের নাগরিক মিলে ‘মহানাগরিক’।
সমস্যার ভীতটা কিন্তু রয়েছে কলকাতার বাইরেই। এখানে কেউ কেউ যেই একটু ভালো
কাজের বাহবা পেলো তক্ষুনি সে পাড়ি দিলো মহানগর। সেখানে সত্যি ভালো করলে তার কাজ
প্রশংসিত হয়। আর যারা জন্মসূত্রে মহানাগরিক এবং ভালো কাজ করছেন তাদেরও কাজ মানুষের
ভালো লাগে। মিডিয়ায় খবর হয়। আর সেই রিভিউ পড়ে আমরা জানতে পারি অমুক দলের তমুক নাটক
অবিশ্বাস্য, ওই ওই অভিনেতা অসাধারণ, এই আলোক শিল্পী, সেই মঞ্চ নির্মানকারী অনবদ্য।
সংগীত নির্দেশক সম্ভাবনাময়। অনেক সময় প্রিভিউও হয়। কিন্তু আপনারা যদি অ-মহানাগরিক হয়ে দারুন কোন নাটক করে
ফেললেন, তবুও আপনাদের নাটকের প্রিভিউ হওয়া সম্ভব নয়। তবে রিভিউ হবে। তার জন্য
আপনাদেরকে অবশ্যই প্রযোজনাটিকে মঞ্চস্থ করতে হবে জেলা কোলকাতায়। কারণ নাটকের
ক্ষেত্রে কোন প্রথম সারির দৈনিক, কোলকাতা জেলাটির বাইরে নাটকের প্রিভিউ তো ভুলেই
যান, রিভিউ করতেও পা বাড়ান না। আপনার জেলার সাংবাদিক প্রতিনিধিরাও সে বিষয়ে হয়
উদাসীন বা উপর মহলের আদেশ নেই। ফলত আপনার থিয়েটার স্থান পাবে জেলার পাতায়। যা
পৌছবে শুধুমাত্র আশেপাশের দু তিনটি জেলায়। অথচ আপনি বাইশটি জেলার যে কোটরেই
থিয়েটার করুন; যদি চুরি, প্রতারনা বা অন্য কোন বড় অপরাধ করলেন, আপনার কথা তখন উঠে
আসবে মূল পাতায় “প্রতারণার দায়ে ধরা পরলেন নাট্যকর্মী”। শিল্পী তো চায় নিজের শিল্প
মুক্তি পাক অসংখ্য মানুষের কাছে। আর জনমত গঠনে সংবাদপত্রের ভূমিকাকে অস্বীকার করা
যায় কি?
তবে মিডিয়ার দোষ দিয়ে হবে কি! নিজেদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার বড় অভাব
আমাদের। তা না হলে এতো অবহেলা সহ্য করি কিভাবে? নিজেদের গ্রামের বা শহরের
শিল্পীদের অক্লেশে লোকাল আর্টিস্ট বলে আলাদা করি। তাই কোলকাতায় নাটকের বিজ্ঞাপনে
লেখার সাহস পায় “কোলকাতা-হাওড়া ও জেলার নাটকের নাট্যোৎসব”। আপনি বলতেই পারেন ক্ষতি
কি? স্থানীয়কে ‘স্থানীয়’, জেলাকে ‘জেলা’ বললে সমস্যা কোথায়? সমস্যাটা; মানসিকতায়।
জেলার বা মফঃস্বলের নাট্যদল যখন বলা হয়, তখন একটা করুনা মিশ্রিত অবজ্ঞা থাকে তাতে।
জেলার থিয়েটারের মানুষরা কোলকাতায় কোন দল কি কাজ করছে বলে দিতে পারবে। সবটা না
পারলেও মিডিয়ার কল্যানে যেই দলগুলোর কথা জানতে পারছে তাদের সম্পর্কে তো বলতে
পারবেই। কিন্তু সেই সব জেলায় কোন দল কি কাজ করছে? মহানাগরিক নাট্যকর্মীরা তার কতটা
বলতে পারবেন? সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমরা নিজের ঢাক নিজে পেটাচ্ছি, কিন্তু
তারপরেও গুরুত্ব পাওয়া যায় কি? বিদেশ গুরুত্ব দিলে ভারতীয়রা গুরুত্ব দেয়। আর
কোলকাতা সম্মান দিলে তথাকথিত মফঃস্বল দাম দেবে। এই মানসিক ব্যাধি আমাদের গ্রাস করছে।
নিজের শহর বা গ্রামে কাজ করতে গিয়ে আমরা অনেকেই ঠিক করে নিই; ‘আমরা শুধু এই
অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকবো’। কে বলেছে আপনাকে কোলকাতায় শুধু দারুন কাজ হয়। আপনারা যেই
মানের কাজ করেন তার তুলনায় ওখানে ভালো কাজ হাতে গোনা আবার অনেক সময় তাও নেই।
আমাদের হীনমন্যতাই ওদের আত্মবিশ্বাসী করে। ফলত যারা ভালো কাজ করছেন আপনার গ্রাম বা
শহরে তাদের কাজকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। তখন তাদের কেউ কেউ চলে যাচ্ছেন
মহানাগরিক ঐশ্বর্য্যের টানে। আর আমরা তখন বলি ‘অমুক অভিনেতা তো আমাদের শহরের গর্ব,
এই স্কুলে পড়েছে, আমাদের নাট্যদলে কাজ করত’। আর অবচেতনে হিংসা করতে থাকি তাকে। সময়
তাই আত্মসমালোচনার। নিজেদের অবচেতনে ওয়াক ওভার দিয়ে হারতে থাকলে বাংলার থিয়েটারের
ক্ষতি। প্রয়োজন নিয়মিত শিক্ষিত থিয়েটারের ক্লাস এবং চর্চার। কোলকাতায়, থিয়েটারের
পাশাপাশি অনেকেই মিডিয়ায় কাজ করছেন অর্থের জন্য। এখানে সেই সুযোগ নেই। তবু সবাই
যদি চলে যান তবে আপনার শহরে ভালো নাট্যচর্চা হবে কি করে? সরকার নজর দিক যাতে
কোলকাতার মত প্রতিটি জেলায় যেন বেশ কয়েকটা নাট্যমঞ্চ থাকে। যেখানে থাকবে থিয়েটারের
সুপরিকাঠামো। মঞ্চ ভাড়া নিয়ন্ত্রিত হোক। নিয়মিত নাট্যচর্চা চলুক। কোচবিহার,
জলপাইগুড়ি, দুই দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ, মালদা, দুই বর্ধমান, দুই চব্বিশ পরগণা, দুই
মেদিনীপুর, নদীয়া, বীরভূম, ঝারগ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া সহ অন্যান্য জেলাতেও বহু
নাট্যদল অসম্ভব ভালো কাজ করে চলেছেন। তাই সব জেলার নাটক আমাদের দেখা উচিৎ। কোলকাতা
জেলায় নাটক দেখার আমন্ত্রন পাই ফোনে, মেসেজে। বিজ্ঞাপন দেখেও অনেক ছুটে যাই নাটকীয়
মুহুর্তের সাক্ষী হতে। আসানসোল থেকে কোলকাতায় নাটক দেখতে গেলে সকালের ট্রেন ধরতে
হয়। নাটক দেখে ফিরতে ফিরতে প্রায় ভোর হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রায় কুড়ি ঘণ্টা ও অনেকগুলি
টাকার ব্যাপার। এইবার সেই আসানসোলেই নাটক দেখতে আসতে বললে তারা বলেন; “আসানসোল
(আপনার জেলার নাম পড়ুন) তো অনেক দূর। কোলকাতায় হলে বলবেন”। কিন্তু কোলকাতায় হলেও,
তাদের অনেকেরই উৎসাহ হয়না প্রযোজনাটি দেখার। ফলত জানবেন, কোলকাতার বহু নাট্যকর্মী
কূপমণ্ডুকে পরিণত হয়েছে। সারা বাংলায় যে কত কালজয়ী কাজ হয়ে চলেছে তার খবর তারা বা
সংবাদপত্র কেউ রাখেন না। অথচ কোলকাতা থেকে বাইশটি জেলায় কল শো পাওয়ার ছিপ ফেলা
চলছেই। কক্ষনও যাদের নাটক দেখেননি, তাদের
ফোন করে যেচে আমন্ত্রণ চাওয়ার ঔদ্ধত্যের জন্য লজ্জা পাওয়া উচিৎ। জেলা কোলকাতার
অধিকাংশ নাট্যকর্মীর উন্নাসীকতা, বাইশটি জেলার কিছু নাট্যকর্মী ও দর্শকের
হীনমন্যতা এবং মিডিয়ার অলসতা বাংলা থিয়েটারের ক্ষতি করছে। থিয়েটারের যেই অদৃশ্য
কাঁটাতার কোলকাতা ও বাইশটি জেলার মধ্যে টেনে রেখেছি আমরা, বাংলার তেইশ জেলার সমস্ত
নাট্যকর্মী আর মিডিয়া মিলে তাকে উপড়ে ফেলতে হবেই। নাট্যমেব জয়তে।
Very thoughtful article. But remember good work will be recognized whereever and whenever is created. Maybe it'll be delayed but can't be denied.
ReplyDeleteKolkata has been enriched by talents from districts or mofussal for ages. That's the tragedy of paschim bango whether we like or not.
Keep going people will recognize. After all kobi jeebanando also depicted banalata seen from Nator notfrom kolkata. Keep it up.
Thanks for your valuable comment. You also can share your thoughts.
DeleteGood article. Well thought. Kolkata always dominates in the mind set of bango basi. Can't help. But will change. Meanwhile let mofussal perform as per it's talent. It will flourish.
ReplyDeleteThanks for your valuable comment. You also can share your thoughts in our blog.
DeleteGood article. Well thought. Kolkata always dominates in the mind set of bango basi. Can't help. But will change. Meanwhile let mofussal perform as per it's talent. It will flourish.
ReplyDelete