আমিও সেদিন ‘সর্বনাশের তীরে’
রাজা অয়দিপাউস
আমিও সেদিন ‘সর্বনাশের
তীরে’ –
চন্দন সেন
“বিদ্বেষের ব্যাকরণঃ- একটি গৌরচন্দ্রিকা”
আমার বাবা তখন পলাশীতে। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। বদলীর চাকরী। যেখানে পোস্টিং হয় সেখানেই সুযোগ পেলেই থিয়েটার করেন, করান। ১৯৬২-৬৩-তে তাঁর সঙ্গে আমিও বদলী; কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে মালদা কলেজ। এর মধ্যেই বাবা আমাকে বুঝিয়ে ছেড়েছেন, ডি এল রায় – ক্ষীরোদপ্রসাদের চেয়ে বড় নাট্যকার নেই আর শিশির ভাদুড়ীর চেয়ে বড় অ্যাক্টার কোনদিন জন্মাবে না।
খুব জনপ্রিয় ডাক্তার আর সুযোগ পেলেই হাততালির পায়রা ওড়ানোর অভিনয় ক্ষমতা। ব্যাস, বাবার বাক্য মানে বেদবাক্য। আমার সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ারে তখন রীতিমত বাবার জন্যই কারফিউ। মগজের রাস্তায় তাঁর চলার বাইরে বিশেষ কোন নাট্যজনের এন্ট্রি নেই। মালদা কলেজ আমার দ্বিতীয় সম্মোহন পর্ব। প্রিন্সিপাল, ছাত্ররাজনীতি আর প্রেম। একই সঙ্গে তিন পর্ব কি করে চালিয়ে যাচ্ছিলাম কে জানে? তার উপর ইংরেজি অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশানের ক্লাস। কোনরকম গাইড-বই-হীন অনার্স-চর্চা। আমরা ৮-৯ জন কুলীন ছাত্রছাত্রী প্রায় প্রতিদিন প্রিন্সিপালের সামনে। গ্রীক ট্র্যাজেডি হয়ে শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট পড়াচ্ছেন তিনি। মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা আমরা, ক্লাস ছাপিয়ে তাঁর ব্যক্তিত্ত্বের সম্মোহন। জানা গেল এই জনপ্রিয় বৃহৎ মানুষটি মার্ক্সবাদী (যদিও কোনদিন মুখ ফুটে তা বলেননি)। সেই অপরাধে কোচবিহার থেকে নির্বাসিত। এখন ৫২ বিঘার আম বাগানের মধ্যে একটি নতুন কলেজকে বড় করার স্বনির্বাচিত দায় সামলাচ্ছেন। ব্যাস, তাঁর কথা শুনেই তাঁকে দেখেই আমাদের মত দু একজনের মধ্যে তখন মার্ক্সবাদী হবার ছেলেমানুষী প্রতিজ্ঞা। অ্যাডোলিসেন্স আর প্রথম যৌবনের দোলাচলে বায়োলজিক্যালি চাড়া দেওয়া হিরোয়িজমের দেখনদারি চলছে। এস্ট্যাব্লিশমেন্ট ভাঙবো, শাসকদলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করব – এমন সব আগুনখেকো শপথ। এসবের সাইড এফেক্টে একাধিক প্রেমে পড়া! এমনই একজন কোলকাতা থেকে ফিরে এসে একদিন প্রেমপত্রের বদলে একটি ইংরেজি দৈনিকের (সম্ভবত অমৃতবাজার পত্রিকা) কাটিং দেখাল, বলল – তোমার জন্য নিয়ে এসেছি। নিজে দেখে এলাম। পারলে দেখে এসো। শম্ভু মিত্রর ‘পুতুল খেলা’। ইবসেন। কাগজের মধ্যে শম্ভু মিত্রের দুটি নাটকের সচিত্র বিবরণ – ‘পুতুল খেলা’ আর ‘রক্তকরবী’।- আবার বলল ‘শম্ভু মিত্র’!- ভাবতে পারবে না, দেখে এসো। বুঝলাম – প্রেমের কথা এরপর চটকে যাবে। মেয়েটা এমনিতে খুব সিরিয়াস, অন্য প্রেমে পড়েছে সে! – রাগ হল শম্ভু মিত্রেরই ওপর। বাবার বলা সিলেবাসে তাঁর নাম নেই। মালদা শহরে তাঁর কথা কজন খবর রাখে? ২৫ কিলোমিটার দূরে বাবার হাসপাতালের আশেপাশে ঘোষবাবুদের মহল্লায় আর রাজবংশীদের পাড়ায় কে আমায় তাঁর ভালো-মন্দ নিয়ে বলে দেবে কিছু! শেষে ছাত্র ফেডারেশানের দাদাদের ধরলাম, যেখানে মাঝেমাঝেই ইংরেজবাজারের প্রাক্তন বিধায়ক বিমল দাস আসতেন। সব্বাই মিলে সেদিন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, দুজন তো মারমুখি। লোকটা রেনিগেড। ‘নবান্ন’, ‘ল্যাবরেটরি’র পর যেই একটু খ্যাতি হল, আমাদের ইপটাকে ছেড়ে দিলো। আমাদের দর্শনকে ভেংচি কেটে ‘ভালো নাটক’ নামাতে গিয়ে কী নামাল অ্যাদ্দিনে? –‘কাঞ্চনরঙ্গ, পুতুল খেলা’! পার্টি (বুঝলাম না ইপটা আর পার্টি সমার্থক হয় কি করে?) তাঁকে মঞ্চ দিলো, প্ল্যাটফর্ম দিলো, জনপ্রিয়তা দিলো! – অফকোর্স তাঁর মধ্যে অভিনয় ক্ষমতা আছে, পরিচালনার ক্ষমতাও আছে। সো হোয়াট? ক্ষমতা তো পিরানদেল্লোরও ছিল, সে তো মুসোলিনিকে সাপোর্ট করেছে। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে তাত্ত্বিক বৃদ্ধরাও এবার আমার মাথা ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন। শম্ভু মিত্রের নাটকে চটজলদি জনপ্রিয়তার উপাদান থাকতে পারে, চমক থাকতে পারে। সস্তা মজার প্যাচ আর বিদেশি ধনবাদী সভ্যতার চালচিত্র থাকতে পারে কিন্তু কোনো প্রগতিশীল দর্শন নেই। বুঝলে? – এই, দেখা তো ওকে কাগজগুলো। দেখো – গণনাট্য সংঘের একজন প্রাণপুরুষ সূধী প্রধান কি বলেছেন? ওর গালাগালগুলো পড়ো! আর ঐ কাগজটা নিয়ে আয় তো, ঐ যে দীপেন বাড়ুজ্জের মত একজন অল্পবয়সী মার্ক্সবাদী লেখক কী বলছেন? আর ঋত্বিক ঘটক!- ব্যাস ব্যাস আমার চোখে জল চলে আসছিল অপরাধবোধে! প্রেমিকা সেই সুদর্শনার ওপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল। বিপন্ন আমি বারবার ভাবছিলাম, একবার সোজা ছুটে যাই ২৫ কিলোমিটার দূরে আমার নাটুয়া (ডাক্তার) বাবার কাছে। উপায় ছিল না। শেষে সেই সন্ধ্যায় সোজা প্রিন্সিপালের কাছে। স্যার, আমি ভুল করে ফেলেছি। যে কোন কারনেই হোক শম্ভু মিত্রকে নিয়ে একটু উচ্ছাস প্রকাশ করে ফেলেছি! তাঁকে বলতে পারিনি আমার আকস্মিক উচ্ছাসের উৎস। স্যার বললেন, ভুল কেন? তুমি তো এখনও তাঁর নাটক দেখনি। শুনে বলেছ। একবার দেখে এসো। একটু আস্বস্ত হওয়া গেলো। বেরুবার সময় তাঁর ভারী গলায় গ্রীক কোরাসের প্রাজ্ঞ গাম্ভীর্য – সেদিন সেফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ থেকে শেক্সপিয়ারের ‘হ্যামলেটে’ আসার সময় কী বলেছিলাম মনে আছে? দুজনেই এমন এক সত্যকে জেনেছিলেন, একজন হয়তো একটু আগে, একজন অনেকটা পরে, যা না জানলে তাঁদের কতটা ক্ষতি হত জানি না, তবে পাঠক বা দর্শকদের প্রবল ক্ষতি হত। সত্যকে আবিষ্কারের যন্ত্রণাটা বুঝবে না? এই বোঝাটার মধ্যে অন্য একটা আনন্দ আছে। পরখ করে দেখে নিও। লোকের মুখে শুনে তাঁকে নিয়ে উচ্ছাস দেখাতে গেলে কেন? লোকের মুখে শুনে তাঁকে জানা বা তাঁর নাটককে জানা অপরাধ বলে ভাবছ কেন? সেই সন্ধ্যায় ভারমুক্ত আমি সোজা সেই সুদর্শনার বাড়ির গেটে। ডেকে নিয়ে তার হাতে ছোট্ট চিরকুট দিয়ে এলাম – ‘আমি তাঁকে পড়ব, আমি তাঁকে দেখব’।
Play -"Putul Khela" Picture Courtesy - Nemai Ghosh |
১৫ জুন, ১৯৭৮ – রাজা অয়দিপাউস (‘এখনো গেলো না আঁধার…’)
এসব চপলতা মেশানো ঘটনাবলীর পর তখন এক যুগ
কেটে গেছে। সেই বারো বছর ধরে অনেক কিছু পড়ছি, লিখছি (বেশীর ভাগই অ্যাজিটপ্রপ নাটক বা
রাজনৈতিক দর্শনের বোকাবোকা ছানাপনা)। আবার সংকটেও পড়ছি, যা লিখছি তাকে বিশ্বাস করছি
না পুরোপুরি। আর যা বিশ্বাস করছি তাকে পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারছি না। তবে শম্ভু মিত্র
সম্পর্কে নির্বোধ বিদ্বেষ তখন কাটতে শুরু করেছে। অনেক কষ্টে ‘রক্তকরবী’ দেখে ফেলেছি।
তখন আমি দিল্লীতে, জীবনের প্রথম চাকরী। ১৯৬৪। ওখানে বসেই খবরে পড়ছি ‘দুটি অন্ধকারের
নাটক’-এর কথা। ‘রাজা অয়দিপাউস’ আর ‘রাজা’। সেফোক্লিস আর রবীন্দ্রনাথ। ’৬৪-র ১২ জুন
আর ১৩ জুন। মাঝখানে শম্ভু মিত্র। স্যার-এর ক্লাসের কথা মনে পড়ল, মনে পড়ল সেই সুদর্শনার
কথা (সে এখন নিউজার্সিতে সুখী গৃহকোণে) মনে পড়ল, আমার দাদাদের কথা। সঙ্গে সুধী প্রধান
আর দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা।
সময় হল না, সুযোগ মিলল না। মিলল সেই ১৯৭৮-এ।
ততদিনে দিল্লীর চাকরি ছেড়ে নদীয়ায়। প্রচুর টাকার মাইনে ছেড়ে অনিয়মিত বেতনের ইংরাজি
টিচার।
কলামন্দিরে রাজা অয়দিপাউসের শেষ অভিনয়। ব্যাস,
৩০ বছরের পিপাসার্ত যৌবন অনেক কষ্ট, অনেক প্রশ্ন আর সন্দেহ নিয়ে শম্ভু মিত্রের সামনে।
তিনি শেষবার ‘রাজা অয়দিপাউস’, পরিসংখ্যান বলল, এর আগে ১০৩ বার তিনি অয়দিপাউস, তার মধ্যে
৭৩ টি তাঁর নিজের নাট্যদল বহুরুপীর প্রযোজনা আর ৩১টি কল শো। আমি তো এক মাসের হলাহলের
ছাটকাট বুকে নিয়ে হল-শো দেখতেই ঢুকেছি। নাটক দেখে বার হলাম। ওটাই কি জীবনের শেষ সম্মোহন?
তারপরেও তো প্রেম এসেছে, নারী এসেছে, ভালো বই হাতে এসেছে, ভালো নাটক পড়তে পেরেছি, দেখতে
পেরেছি। কিন্তু তেমন সম্মোহিত হলাম কই?-
আমার এতদিনের সব জানা-বোঝার ওপর এমন একটা
ধাক্কা? এর আগে কিম্বা পরে মনে নেই, আমি ছুটে গিয়েছিলাম ‘পরিচয়’ অফিসে। সেই সন্ধ্যায়
ইলেকট্রিকের আলো যে কোন কারনেই হোক জ্বলেনি। দীপেনদা বসে আছেন। সোজা তাঁর কাছে গিয়ে
বলেছিলাম, শম্ভু মিত্র সম্পর্কে আপনি না কি খুব ক্ষিপ্ত ছিলেন দীপেনদা? মোমবাতির আলোয়
‘অশ্বমেধের ঘোড়া’-র স্রষ্টার খর্বাকৃতি চেহারার মধ্যে দিয়ে দীপ্ত চোখদুটো টেবিলের প্রায়
সমান্তরালে। বললেন, বোকার মত, যাকে গ্রাম্য ভাষায় বলে ‘ভূতে পাওয়া’ মানুষের মত তাঁকে
একদিন ঢিল ছুঁড়তে গিয়েছিলাম। এখন দু হাতে তাঁর পায়ে ফুল দিয়েও পাপস্খলন হচ্ছে কই?’-
দীপেনদা অয়দিপাউস দেখে বলেছিলেন অন্ধকারের নাটক নয়, আসলে এটা হচ্ছে আমাদের মধ্যে ‘বোধের
আলো জ্বালানো নাটক’।
‘সর্বনাশের তীরে’ –
১২ জুন, ১৯৬৪-তে রাজা অয়দিপাউসের প্রথম প্রযোজনা।
১২ বছর পর এ নাটকের শেষ অভিনয়ের আমি সম্মোহিত দর্শক। মাঝখানে অনেক ভুল, মিথ্যা আর পরের
মুখে ঝাল খেয়ে দাপাদাপি! আমার সব ধারনাগুলোকে পিষে মারা হচ্ছে মঞ্চে। শম্ভু মিত্র
– রাজা অয়দিপাউস, তৃপ্তি মিত্র – যোকাস্তে। গংগারাজ বসু – মেষপালক। আর কুমার রায় –
দেবতোষ ঘোষ – শান্তি দাস – কোরাস। অভিনয় যে কোন উচ্চতায় যেতে পারে, নাট্যের সবাক ও
নির্বাক ভাষা যে কোন উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে তা বোঝবার সাধ্য আমার নেই। ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের
‘সূর দাসের প্রার্থনা’ কবিতার কথা সম্ভবত শঙ্খ ঘোষ কোথাও উল্লেখ করেছিলেন। বাইরের সমস্ত
আলো যখন নিভে যায়, অন্তরের সত্য তখন জেগে ওঠে।
নাটকের
উপান্তে মেষপালকের মুখোমুখি অয়দিপাউস, সে বড় ভয়ংকর দৃশ্য।
অয়দিপাউস বলে – সেই শিশুকে তুমিই এর হাতে
এনে দিয়েছিলে?...
কোথায় পেয়েছিলে সেই শিশুকে?
কম্পিত মেষপালক বলে, ‘আমি যে এক সর্বনাশের
তীরে এসে দাঁড়িয়েছি’
অয়দিপাউস লাফিয়ে তাঁর ঘাড়ের উপর পড়ে, তাঁর
কাঁধ ধরে বলে- … বলো, ক্রীতদাসের না রাজবংশের কারোর?
মেষপালক তো জানেই শিশুটি রাজা লাইয়াসের গৃহের
সন্তান। এটা একটা ভীষণ জায়গা, আমি সহ্য করতে পারিনি। কারণ আমি ততক্ষণে সেই অন্ধকারকে
আলোর মত দেখতে পাচ্ছি। অয়দিপাউস তার বাপ লাইয়াসকে মেরেছে অজান্তে আর তার জননীকে বিয়ে
করে তার শয্যাসংগী হয়েছে অজান্তে। শরীর আর মনের সেই প্রবল কষ্টের অভিঘাত নিয়ে যখন বার
হয়ে আসছি তখন মনে হচ্ছিল সত্যিই তো, সত্য উপলব্ধির যাত্রা তো আসলে অন্ধকারের ভিতর দিয়েই
আলোয় পৌছুবার যাত্রা। কিম্বা ঐ যে সুকুমার রায় তাঁর চমৎকার ছড়ার হাল্কা চালে গভীর কথা
বলে গেলেন – ‘আলোয় ঢাকা অন্ধকার…’
কিন্তু ওই যে শম্ভু মিত্র এমন আশ্চর্য অভিনয়ের
ব্যাখ্যা দেওয়ার আগে ব্লটিং দিয়ে শুষে নেওয়ার কথা বলেছিলেন – সেটা কি সম্ভব? “অভিনেয়
চরিত্রটিকে নিজের বোধ-বুদ্ধি-অনুভব-আবেগ দিয়ে অর্থাৎ সমগ্র চৈতন্য দিয়ে শুষে নিতে হয়”।
শম্ভু মিত্র বলেছিলেন তাঁর অনুজ অশোক মুখোপাধ্যায়কে (নাট্যকথা শিল্পকথা – ৯৮৮ পৃঃ)
কিন্তু আমরা যারা অভিনেতা হতে পারলাম না, আমরা যাদের বুদ্ধি আছে বোধ নেই, আবেগ আছে অনুভব নেই, শ্রুতি আছে চৈতন্য নেই। তারা অভিনয় বুঝবেন আগে, না শম্ভু মিত্র বুঝবেন আগে? যে রাজনৈতিক অন্ধকার, বিদ্বেষের অন্ধকার, সত্যকে অন্বেষণের অস্বীকারের অন্ধকার ৬০-এর দশকে তাঁকে আর্ত করেছিল, ‘অয়দিপাউস- তারই ফসল, সেই অন্ধকার এখনও জারি আছে।
No comments
Thanks for your comment