সমকালীন বাংলাদেশের শহরকেন্দ্রিক নাট্যচর্চায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নান্দনিকতার দ্বান্দ্বিকতা
সমকালীন বাংলাদেশের শহরকেন্দ্রিক নাট্যচর্চায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নান্দনিকতার দ্বান্দ্বিকতা
ইউসুফ হাসান অর্ক
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশের শহুরে মঞ্চ তথা প্রধানত ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট-বরিশালের নাট্যচর্চায় এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষণীয়। আশির দশকে একদিকে মূলত ভারতের ‘ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা’ থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত কয়েকজন নাট্যজনের ভিন্নধর্মী নাট্য-প্রযোজনার প্রয়াস এবং অন্যদিকে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্য আঙ্গিক নিয়ে নানা অনুসন্ধান-গবেষণা ও নিরীক্ষা শুরু হয়।
পাশাপাশি এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নাট্য শিক্ষা শুরু হয় এ সময়েই (গত শতাব্দীর আশির দশকে); যেখানে বিশ্ব থিয়েটারের পাঠ-এর পাশাপাশি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্য বিষয়ে নানা অনুধাবনের প্রয়াস লক্ষ করা যায় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্মিত প্রযোজনাগুলো থেকে। এমনি প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নাট্যচর্চা বর্তমানে নবতর রূপ নিয়ে বয়ে চলেছে। অন্যভাবে বললে, উপরে উল্লেখিত পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে এই প্রেক্ষাপটকে সনাক্ত করা যেতে পারে। বিষয়টি বর্তমান সময়ের নাট্যজনেরাও কম-বেশি স্বীকার করে থাকেন। এই পরিবর্তনটাকে যদি বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ‘ট্রানজিশন’ ধরে নেই তাহলে তা বাংলাদেশের নাট্যচর্চাকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে সেই প্রশ্ন মনে উদ্রেক হয়। গত আনুমানিক ২৫ বছরের নাট্যচর্চা (মূলত ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট-বরিশালের শহুরে নাট্যচর্চা- যা লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ হয়েছে) বিবেচনা করলে বলা যায়, এই পরিবর্তনের পরবর্তী গন্তব্য খানিকটা অস্পষ্ট; আর সে কারণেই এই লেখার অবতারণা। এই রচনাটি কোনো গবেষণামূলক প্রবন্ধ নয়, বরং গত দুই দশকে দৃষ্ট বাংলাদেশের শহুরে নাট্যচর্চার গতি-প্রকৃতি বিষয়ক একটি অনুসন্ধানী বিশ্লেষণ- যার মূল দৃষ্টিভঙ্গি তাত্ত্বিকের নয় বরং থিয়েটার নামক শিল্প প্রয়োগকারীর। তবে বিশ্লেষণের প্রয়োজনে তত্ত্বের অবতারণা হবে বৈকি।বাংলাদেশে
‘গ্রাম থিয়েটার’ আন্দোলন, ভারত থেকে শিক্ষিত
বাংলাদেশি নাট্যজনদের ফিরে আসা ইত্যাদি
কাছাকাছি সময়ের কথা।
‘গ্রাম থিয়েটার’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গ্রামে
গ্রামে মেলা পত্তন সহ
থানা ও গ্রাম পর্যায়ে
যখন বিভিন্ন নাট্য সংগঠন গড়ে
উঠছে তখন সেলিম আল
দীন, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ সহ আরো
অনেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিরাজমান নাট্য
নমুনাসমূহ পর্যবেক্ষণ করছিলেন। পাশাপাশি
‘আরণ্যক নাট্যদল’ তখন ‘মুক্ত নাটক’
আন্দোলন নিয়ে মাঠে নেমেছে। সেই
সময়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম
শহরে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনও
তুঙ্গে। সৈয়দ
জামিল আহমেদ, তারিক আনাম
খান সহ আরো কয়েকজন
প্রতিভাবান নির্দেশক-অভিনেতা তখন শহুরে মঞ্চে
প্রযোজনার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনয়ন করেন, মূলত
ডিজাইনের ক্ষেত্রে। অভিনয়ের
ক্ষেত্রে স্তানিস্লাভস্কির বাস্তবধর্মী অভিনয়ের বৈজ্ঞানিকতাও তখন থেকেই প্রযুক্ত
হতে থাকে। এনএসডি
ফেরৎ উপরোক্ত নির্দেশক-অভিনেতাগণ মূলত সংস্কৃত কিম্বা
ইউরোপীয় থিয়েটারের ‘বৈজ্ঞানিক’ প্রক্রিয়াকে অবলম্বন করে নাট্য প্রযোজনাসমূহ
নির্মাণ করতে শুরু করেন-
যার মূল ভিত্তি ‘যুক্তি’। প্রযোজনাগুলো
ঢাকার দর্শকদের জন্য সেকালে অভিনব
হিসেবে পরিগণিত হয়। উল্লেখ্য
যে, ঢাকার দর্শক কিম্বা
উপরোক্ত নাট্যজনদের রুচি তখন পর্যন্ত
(এখনও) ইউরোপীয়-সংস্কৃত হাজার বছরের নান্দনিকতার
তাত্ত্বিক ভিত্তি দ্বারা চেতন-অবচেতনে প্রভাবিত। তার
কারণ হিসেবে বলা যায়
যে, বাংলাদেশ স্বাধীন নতুন রাষ্ট্র হিসেবে
তখনো সাংস্কৃতিক ইতিহাস গবেষণার সেই
পর্যায়ে পৌঁছায়নি- যা থেকে এ
দেশ ও জাতির সাংস্কৃতিক
স্বকীয়তা চিহ্নিত করা যায়।
আবার এ কথাও অস্বীকার
করা যায় না যে,
তৎকালীন ভারত-ফেরৎ তরুণ
অভিনেতা-নির্দেশকগণ রেনেসাঁস উত্তর ইউরোপীয় পৃথিবীর
নন্দনতাত্ত্বিক প্রতাপকে (যা মূলত অ্যারিস্টটলপ্রসূত)
অনস্বীকার্য হিসেবে অন্তরে ধারণ
করেন এবং পাশাপাশি সংস্কৃত
নন্দনতত্ত্বের প্রামাণিক ভিত্তিকেও যৌক্তিকভাবেই শ্রদ্ধা করেন। প্রকৃত
অর্থেই, নাটক বলতে তখনো
পর্যন্ত দ্বন্দ্বমুখর একটি কাহিনির ক্রিয়াত্মক-সংলাপাত্মক নাটকীয় উদ্যাপনকেই বোঝানো
হতো। তাই
তখনকার ভারত-ফেরৎ উপরোক্ত
নাট্যজনদের অভিনব প্রয়োগ কৌশলকে
বাংলাদেশবাসী আনন্দের সঙ্গে আলিঙ্গন করে
নেয়। এ
পর্যন্ত তো ঠিকই আছে। সমস্যাটা
দাঁড়ায় খানিক পরে।
নব্বইয়ের
দশকে মূলত সেলিম আল
দীনের গবেষণায় যখন প্রমাণিত হয়
যে, বাঙলা নাট্য প্রায়
হাজার বছরের পুরনো এবং
সংস্কৃত কিম্বা তথাকথিত দ্বন্দ্ব-নির্ভর ইউরোপীয় আদল
থেকে এই নাট্যের আঙ্গিক
ও দার্শনিক অভিপ্রায় ভিন্ন তখনই গোলমালটা
বেঁধে গেলো। বাংলাদেশের
নাট্যজনদের একাংশ গবেষণায় প্রমাণিত
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী আঙ্গিকগুলোকে ‘নাটক’ বলতেই রাজী
নন। কেননা
সেগুলো অ্যারিস্টটলের ট্রাজেডির সংজ্ঞায় মেলে না, আবার
ভরতের শাস্ত্রে উল্লেখিত দশরূপকের মধ্যেও আঁটে না। তাহলে
এগুলো কী? নাট্যশাস্ত্রে যদিও
এগুলোকে ‘ওড্রমাগধী’ -রীতি হিসেবে অভিহিত
করা হয়েছে। কিন্তু
বাঙালির নন্দনতত্ত্বকে প্রতাপসহ প্রমাণ করবে এমন
শাস্ত্র কোথায়? রূপ গোস্বামীর
‘ঊজ্জ্বলনীলমণি’ কিম্বা চৈতন্যদেবের অচিন্ত্য
দ্বৈতাদ্বৈতবাদী দর্শন যে বাঙালির
নন্দনতাত্ত্বিক বোধকে প্রভাবিত করতে
পেরেছিলো- সেই বাঙালির মানস
তখন ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক
শাসনের যাতাকলে নিভৃতচারী। কাজেই
কতিপয় গবেষকের তত্ত্বকথায় কি আর ‘থিয়েটার’
ব্যাপারটা উল্টে যাবে? অতএব,
থিয়েটারটা হয় অ্যারিস্টটল কিম্বা
ভরত এই দুইয়ের ছকে
না পড়লে সেটা অন্য
কিছু হতে পারে- ‘থিয়েটার’
বা ‘নাটক’ নয়; ‘রিচুয়াল’,
‘নাট্যমূলক উপস্থাপনা’ এরকম কিছু একটা। এখানেই
দ্বন্দ্ব শুরু। লেখকের
সংশয়টা এইরকম : ‘থিয়েটার’ বা ‘নাটক’-ই
অভিধা দিতে হবে কেন?
এই ভারতেই তো উদাহরণ
আছে যেখানে ‘কুটিয়াট্টম’ বা ‘কথাকলি’-কে
সে-নামেই ডাকা হচ্ছে। জাপানে
‘নো’ কিম্বা ‘কাবুকি’-কে নো-কাবুকি
বলেই ডাকা হচ্ছে।
‘নো থিয়েটার’ বা ‘কাবুকি থিয়েটার’
নামে তো জাপানিরা ডাকে
না। শ্রেণিভুক্ত
করার প্রয়োজনে গবেষকভেদে কেউ কেউ (বেশিরভাগই
পাশ্চাত্য বা সংশ্লিষ্ট ভাবধারার
গবেষক-তাত্ত্বিক) তাদের ‘থিয়েটার’ হিসেবে
সনাক্ত করেন। আমাদের
দেশে সেটা করতেই অনেকের
বাঁধলো। তাই
সেই সময় থেকে বাংলাদেশের
নাট্যচর্চায় নন্দনতাত্ত্বিক দ্বান্দ্বিকতার শুরু হয়।
একদল পাশ্চাত্যের শিল্পসূত্রকে একমাত্র বা সর্বোপরি মাপকাঠি
ধরে নাট্যচর্চার সৌন্দর্য বা স্বার্থকতা বিচার
করেন, আরেকদল কেবল ‘দেশজ
আঙ্গিকে হলো কিনা’ সেটা বিবেচনা করেন। একদল
কাহিনির enactment,
conflict, unity of time-space-action ইত্যাদি খুঁজছেন, আরেকদল ‘বর্ণনাময়তা’, ‘বর্ণনার স্বকীয়তা’, ‘গীত’, ‘নৃত্য’ ইত্যাদির
প্রয়োগে তা ঐতিহ্যাভিমুখী করার
চেষ্টা করছেন স্ব স্ব প্রযোজনায়। তাই
সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে একদল আরেকদলকে সমালোচনা
করছেন ‘থিয়েটার হয়নি’ কিম্বা ‘দেশজ নাটক হয়নি’
বলে।
‘থিয়েটার’
কী এই নিয়ে বিস্তর
গবেষণা হয়েছে, এখনও অবিরত
চলছে নানা মতদ্বৈততা।
পাশাপাশি এই শব্দটির বঙ্গীয়করণ
নিয়েও নানা মতামত রয়েছে। তাই
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নন্দনতাত্ত্বিক
ধারণাগত দিক থেকে দেখলে
আমরা এই শিল্পটি নিয়ে
যে সিদ্ধান্তে আপাতভাবে পৌঁছাই তা একাধারে পাশ্চাত্য
ও বঙ্গীয় অভিধা দিয়ে
সাঙ্গীকৃত হয় কিনা তা
বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সহজভাবে
বললে ‘থিয়েটার’ ও ‘নাট্য’ একই
শিল্পের দ্বি-ভাষিক অভিধা
কিনা তা বিশ্লেষণ করা
প্রয়োজন। পিটার
ব্রুকের ভাষ্যমতে, একটি ত্রিমাত্রিক শূন্যস্থান,
নূন্যতম একজন জীবন্ত অভিনেতা
আর নূন্যতম একজন জীবন্ত দর্শক
হলেই ‘থিয়েটার’ নামক শিল্পটির শর্ত
পূরণ হয়ে যায় (পিটার
ব্রুকের ‘দ্য এম্পটি স্পেস’ অনুসারে)। উদ্দেশ্যগত
দিক থেকে বিচার করলে
গ্রোতোওস্কির থিয়েটার আত্ম-উন্মোচনের শর্ত
রাখে। আবার
ব্রেখটসহ আরো কেউ কেউ
অ্যারিস্টটলের ট্রাজেডির সংজ্ঞাকে অতিক্রম করে ‘এপিক’ কিম্বা
তারও পরবর্তী সময়ে ‘পোস্ট-ড্রামাটিক
থিয়েটার’ অভিধা দিয়ে এই
শিল্পটির বিস্তৃতি বিচার করছেন।
এ সমস্ত মতবাদ এবং
তদীয় নাট্যচর্চার গতি-প্রকৃতি বিচার
করলে বোঝা দূরূহ নয়
যে ‘থিয়েটার’ নামক শিল্প আঙ্গিকটি
বহুমাত্রিক। আবার
সংস্কৃত থেকে আগত বাংলা
অভিধা ‘নাট্য’ বলতে পারিভাষিকভাবে
‘রস’-এর শর্তসহ একটি
শিল্প আঙ্গিককে প্রকাশ করে বলে
মতামত লভ্য।
কাজেই,
‘থিয়েটার’ ও ‘নাট্য’ অভিধা
দু’টি ভিন্ন ভাষাজাত
এবং ধারণাগত সাদৃশ্য সত্ত্বেও তা হুবহু অভিন্ন শিল্প
মাধ্যম এ কথা বলা
যায় কিনা এই নিয়ে
তর্ক হতে পারে।
কেননা, ‘থিয়েটার’ বিষয়ে পাশ্চাত্যের তাত্ত্বিকদের
যে মতামত পাওয়া যায়
তাতে কোথাও ‘রস’ ধারণাটি
লভ্য নয়। আবার
শাস্ত্র মতে যে রসাশ্রিত
শিল্প আঙ্গিক ‘নাট্য’ তাও আবার
ট্রাজেডির সংজ্ঞায় প্রাপ্ত একটি ক্রিয়ার অনুকরণের
কথা বলে না, আত্ম-উন্নয়ন বা সমাজ
সংস্কারের কথাও স্পষ্ট করে
বলে না। অপরদিকে,
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী যে নাট্য আঙ্গিকগুলো
রয়েছে বলে অধুনা বাংলাদেশের
গবেষণালব্ধ তাও ভরত নাট্যশাস্ত্রের
প্রতি পুরোপুরি অনুগত নয়।
বরং তা উপরূপক উপাধি
নিয়ে শাস্ত্রকারদের আলোচনায় স্থান পেয়েছে।
কাজেই বাঙলা ঐতিহ্যবাহী নাট্য
আঙ্গিক বলতে আজ পর্যন্ত
বহমান ‘গাজীর গান’, ‘পালাগান’,
‘ভাসান গান’, ‘কুশান গান’ ইত্যাদি
আঙ্গিকসমূহকে পাশ্চাত্য নন্দনতত্ত্ব প্রসূত শিল্প শ্রেণি
কিম্বা ভারতীয় শাস্ত্র কোনোটার
মধ্যেই স্থান না পেয়ে
অগত্যা নিজ স্বকীয়তা নিয়ে
স্বনামে স্থানীয়ভাবে অভিহিত হচ্ছে।
গবেষকগণও বিশ্লেষণের প্রয়োজনে সংস্কৃত ও পাশ্চাত্য প্রতিষ্ঠিত
নন্দনতত্ত্বের ভয়ে সংশয়সহ সেগুলোকে
নাট্য আঙ্গিক হিসেবে সনাক্ত
করছেন মাত্র আজকাল।
সম্ভবত এ বিষয়ক সূত্রাবদ্ধ
কোনো নন্দনতত্ত্বের গ্রন্থ এখনো প্রকাশিত
বা আজকের ইউরোপ শাসিত
বিশ্ব দ্বারা সমাদৃত হয়নি
বলেই বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত নাট্যজনদের বেশিরভাগই এগুলোকে শিল্প আঙ্গিক হিসেবে
স্বীকৃতি দিতে নারাজ।
তাই ঐতিহ্য প্রণোদিত আজকের
‘বর্ণনাত্মক নাট্যরীতি’তে লিখিত ও
প্রযোজিত নাটকগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের ঘাটতি
কিম্বা গীত-নৃত্যের আধিক্য
থাকলে লোকে বলছে, ‘সব
আছে, কিন্তু নাটকটা কোথায়?’,
কিম্বা ‘এটাতো গীতিনাট্য হয়ে
গেলো’ ইত্যাদি। লেখকের
প্রশ্ন হলো তাহলে ‘নাটকটা
তাহলে কী?’ নব্বইয়ের দশকের
আগে পর্যন্ত আমরাও মনে করতাম
একটি উঁচু অভিনয়ভূমি একদিকে
দর্শক, চরিত্রানুগ বেশভূষা ও সংলাপ-আচার-আচরণ, দ্বন্দ্বমুখর দৃশ্য,
ক্লাইমেক্স এই না হলে
বোধ হয় নাটক হয়
না। কিন্তু
এখন তো তথ্য প্রযুক্তির
প্রশ্রয়ে সারা পৃথিবীর কতো
ধরনের ‘থিয়েটার’-এর সাথে আমাদের
পরিচয় হয়ে গেছে।
তাছাড়া রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনতো
সরকারি হিসেবে অনেক আগেই
শেষ হয়ে গেছে।
এখনো যদি সেই পুরনো
উত্তরই পেতে হয় যে,
‘নাটকীয়তা, দ্বন্দ্ব, ঘটনার ঘনঘটা-তবেই
না নাটক হলো’ - তাহলে বলতে হয়,
‘ইউরোপীয় স্কেল দিয়েই এখনো
আমাদের মূল্যায়নটা করতে হবে?’ এখনো
আমাদের মস্তিষ্কে ইউরোপীয় আদলটাকেই আদর্শ ধরে কথা
বলতে হবে? -আর কতকাল?
আসলে এই অবস্থায় আমাদের
থাকার পেছনে একটি ঐতিহাসিক
বাস্তবতা প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করছে
বলে মনে হয়।
একটু পেছন ফিরে তাকিয়ে
উপরে উল্লেখিত সমস্যাটা দৃষ্টান্ত সাপেক্ষে আলোচনা করে দেখা
যাক। আশির
দশকের কথা। দেশীয়
নাটকের পাশাপাশি প্রথম সারির দলগুলোর
অনেকেই অনুবাদ/রূপান্তরিত নাটকের
প্রযোজনার দিকে মনোনিবেশ করেন
যার বেশিরভাগই ছিলো ইউরোপীয় আদলে
গঠিত তথা আরিস্টটলীয় নন্দনতত্ত্বের
প্রতি অনুগত। এদের
মঞ্চায়নও হয় ইউরোপীয় চরিত্রাভিনয়রীতি
তথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ধাঁচে নির্মিত তৎকালীন
প্রসেনিয়াম মঞ্চে। দৃষ্টান্তস্বরূপ
মলিয়েরের রূপান্তর ‘বিদগ্ধ রমণীকূল’(১৯৭৩)
থেকে শুরু করে আলবেয়ার
কামুর ‘ক্রস পারপাস’ (১৯৭৩), এডওয়ার্ড এলবি’র ‘এই নিষিদ্ধ
পল্লীতে’(১৯৭৩), ফেরেঙ্ক মলনার-এর ‘ভেঁপুতে বেহাগ’(১৯৭৪), বের্টল্ট ব্রেখটের
‘সৎ মানুষের খোঁজে’(১৯৭৫), ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’(১৯৭৭), নিকোলাই গোগলের
‘ইন্সপেক্টর জেনারেল’
(১৯৮১), ইয়াভনি সোয়ারটেজ-এর
‘রাক্ষস খোক্কস’(১৯৮৪), দ্যারিও ফো’র ‘আঃ কমরেড’(১৯৮৭), জে বি
প্রিস্টলীর ‘খোলস’
(১৯৯৭), আর্থার মিলারের ‘ক্রুসিবল’
(১৯৯৮) কিম্বা ‘ডেথ অব এ
সেল্স ম্যান’, ইউজিন ও নীলের
‘গণ্ডার’ ইত্যাদির
নাম উল্লেখ করলে কম
বলা হয়। কেননা,
শেক্সপিয়র, ইবসেন, মলিয়ের, আন্তন
চেখভ এঁদের রচিত নাটকের
অনুবাদ/রূপান্তর এতো বেশি যা
এই লেখার পরিসরে উল্লেখ
করাও সম্ভব নয়।
নিঃসন্দেহে এই নাটকগুলো বিশ্বজুড়ে
তাদের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণ করেছে।
বিষয়টি
যদি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে
দেখা যায় তাহলে কেমন
হয়? এতো যে বিশ্ববিখ্যাত
নাটকের অনুবাদ ও রূপান্তরের
প্রচল আমাদের দেশে, তা
কেন? নাটকগুলো ভালো এ কথা
স্বীকার করেই বলা যায়,
এই ‘ভালো’র ধারণাটি
কী ধ্রুব? এই ‘ভালো’
পরিমাপের মাপকাঠিটি কী? আ্যরিস্টটল? হোরেস?
লনজাইনাস? আবার, আর কোনভাবে
অথবা পরিমাপের অন্য কোনো মাপকাঠি
দিয়ে বিচার করলে নাটকগুলো
ভালো হওয়ার পাশাপাশি আর
কোনো সত্য উন্মোচিত হয়
কী? এই নাটকগুলোর শ্রেষ্ঠত্বকে
স্বীকার করতে গিয়ে অতি
গোপনে আমরা এ সমস্ত
নাটকগুলোর আঙ্গিক ও গাঠনিক
আকৃতিকে থিয়েটার বা নাট্য বিষয়ে
একমাত্র মডেল হিসেবে ধরে
নিয়েছি কিনা এটাও মনে
রাখা প্রয়োজন। স্পষ্ট
করে বললে, এদের প্রয়োগের
জোয়ারে আমরা সেই গঠন
ও রীতি চর্চার অভ্যস্ততায়
‘বদ্ধমূল এক নাট্য ব্যাপারের’
দিকে আমাদের মানসিকতাকে নিয়ে
গিয়ে কূপমুণ্ডুকতার সীমাবদ্ধ পরিসরে নিক্ষিপ্ত হয়েছি
কিনা। আর
সেই সীমাবদ্ধ ও বদ্ধমূল ধারণার
ফলেই আমরা সেই অভ্যস্ত
নাট্যময়তার বাইরের কিছুকে নাটক
বা থিয়েটার বলতে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছি
কিনা। এই
প্রশ্নগুলোকে ‘ইউরোপ-বিরোধী মানসিকতা’
তথা তথাকথিত ‘অনাধুনিকতা’ হিসেবে প্রচার করা
হয়েছে গত কয়েক দশক
ধরে। প্রচারটা
হয়েছে খুব সহজেই, কেননা,
ইউরোপের প্রতিষ্ঠিত নন্দনতত্ত্বের পক্ষের লোকই অধিক,
আবার ইউরোপের রেনেসাঁস আমাদেরকে প্রয়োজনের নতুন মানে করবার
জন্য ‘যুক্তি’ দিয়েছে, সাথে দিয়েছে প্রয়োজন
মেটাবার ‘উপায়’ হিসেবে নৈতিকতার নতুন
সংজ্ঞা। কিন্তু
‘অপ্রয়োজন’ যা ভারতীয় দর্শনের
গোড়ার কথা, তার কী
হবে? আসলে ‘অপ্রয়োজন’ নিয়ে
ভাববার অবকাশ কোথায়? অনেকেই
বলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাববার অবকাশ ছিলো,
কেননা তাঁর অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা
ছিলো। অর্থনৈতিক
অসঙ্গতি ও তথাকথিত ‘মৌলিক
চাহিদা’ মেটাবার ঘোড়-দৌড়ে আমরা
এখন যে ব্যস্ত! রবীন্দ্রনাথের
ভাষায় ‘যার কোনো মানে
নেই’ তাকে নিয়ে ভাববার
অবকাশ আমাদের নাই।
ভেবে কী লাভ? যেখানে
‘লাভ’ নাই সেটার চর্চার
‘দরকার’ নাই। এটাই
আমাদের মতো দেশের জন্য
ঔপনিবেশিকতার সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ। আবার
আমাদের দেশে আরেক দল
আছেন যারা ‘দেশজ’ বলতে
এমন অজ্ঞান যে বিশ্বকে
অস্বীকার করার মতো তাদের
ধৃষ্টতাও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ইউরোপীয়
হলেই যেন পরিত্যাজ্য।
যেন সমস্ত ‘ভালো’ কেবল
‘দেশজ’ হলেই হয়।
এটা স্বদেশপ্রেম নয় বরং কূপমুণ্ডুকতা। আর
বর্তমান বাংলাদেশের ‘শিক্ষিত’ ও ‘শহুরে’ নাট্যচর্চায়
বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিরাজমান নান্দনিকতার
দ্বন্দ্বের ভ্রূণ এখানটাতেই আছে
বলে অনুভূত হয়।
বলা যায়, মানসিকতার ঔদার্য্যরে
আবর্তের মধ্যেই তাহলে সমস্যাটা
লুক্কায়িত। করণীয়
কী?
মানসিক
ঔদার্য্য বিষয়টা আমাদের শহরকেন্দ্রিক
নাট্যচর্চায় কোন পর্যায়ে আছে
বিবেচনা করতে গেলে লক্ষ
করি যে উপরে উল্লেখিত
অনুবাদ বা রূপান্তরিত নাটকগুলো
যারা করছেন তারা শত
নিরীক্ষার মধ্যেও শেষ পর্যন্ত
ইউরোপীয় বাস্তববাদী ধারার অভিনয় তথা
‘ফোর্থ ওয়াল’ ধারণাপ্রসূত জীবনানুরূপ
আচরণের বাইরে গিয়ে অভিনয়
তথা নাটককে নিয়ে যেতে
পারছেন না, বা চাইছেন
না। নব্বইয়ের
দশকের কোন কোন নির্দেশক
এই ২৫ বছর পরে
এসেও একই ধারণার আবর্ত
থেকে নিজেকে মুক্ত করে
নাট্য ব্যাপারটি ঘটানোর মতো সাহস
করছেন না। কেনই-বা করবেন, বাস্তববাদী
ধারাটি স্বীকৃত এবং নিরাপদ; তাই
দিয়ে যদি দর্শককে বিমোহিত
রাখা যায় তাতেই তো
হলো। আবার
কখনো কখনো দেখা যায়,
মঞ্চে ‘নায়ক-নায়িকা’ কিম্বা
কেন্দ্রীয় চরিত্রের ভাবভঙ্গি ইত্যাদি রূপায়ণ করবার প্রয়োজনে
নির্দেশকগণ অভিনেতাদের ইউরোপীয় কিংবদন্তি চরিত্র কিম্বা সংস্কৃত
নাট্যের ‘নায়ক-নায়িকা-লক্ষণ’
থেকে দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন। নাটকীয়তা
নির্মাণের ক্ষেত্রেও ইউরোপীয় কিম্বা সংস্কৃত নন্দনতত্ত্বজাত
‘দ্বন্দ্ব’-এর ধারণা প্রযুক্ত
হচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। এই
দৃষ্টিভঙ্গিটি বদ্ধমূল ধারণাজাত বলেই মনে হয়। আজকের
মানুষ তো তথ্য প্রযুক্তির
প্রশ্রয়ে আরো বিরাট পৃথিবীর
বহু দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিচিত।
শুধু ইন্টারনেটই আমাদের পরিচয় করিয়ে
দেয় দূর প্রাচ্য থেকে
শুরু করে আফ্রিকা পর্যন্ত
নানান দৃষ্টিভঙ্গির সাথে। জীবনবোধের
নানা রঙের সাথে।
সেই নানান রঙে মানুষ
আজ থিয়েটারকে দেখতে শিখেছে।
কাজেই, আজকের দিনে হ্যামলেট
করতে গেলে আজকের মানুষের
জন্য এবং আজকের মানুষের
উপযোগী করেই মঞ্চে আনতে
হবে। এই
যে যুগোপযোগী করে আনতে না
চাওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি সেখানে মানসিকতার ঔদার্য্যরে
অভাব কিম্বা ঔপনিবেশিক দাসবৃত্তি
বসবাস করছে বলে সনাক্ত
করা সঙ্গত বলে বোধ
হয়। তবে
এ কথাও বলতে হবে
যে কেউ কেউ করছেন। নব্বইয়ের
দশক থেকে অন্তত গোটা
এক ডজন প্রযোজনা হবে
যারা ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে নাট্য
ব্যাপারটি উদ্যাপন করেছেন। হয়তো
তাদের সকল নিরীক্ষা সব
সময় সফল হয়নি, কখনোবা
হয়েছে। সফল
না হওয়ার নানা কারণও
আছে। অভিনেতার
সামর্থ্য, নির্দেশক অভিনেতার বোধ-বুদ্ধি-নান্দনিকতার
ঐক্য, সামষ্টিক চিন্তায় ঔপনিবেশিকতার বসবাস, দর্শকপ্রিয়তা লাভের
জন্য আমাদের থিয়েটারের বিপণন
ব্যবস্থা ইত্যাদি নানা কারণে একটি
প্রযোজনা দর্শকপ্রিয়তা কম পেতে পারে। তবু
যারা এই উদ্যোগগুলো নিয়েছেন
তাদের সাধুবাদ জানানো আমাদের কর্তব্য।
দৃষ্টিভঙ্গি
তথা মানসিক ঔদার্য্যরে বিষয়ে
‘দেশজ’ আঙ্গিক নিয়ে যারা
কাজ করছেন তাদের বিষয়েও
বক্তব্য রয়েছে। মূলত
নব্বইয়ের দশক থেকে ‘বাঙলা
বর্ণনাত্মক রীতি’র নাট্যচর্চা
এদেশে শুরু হয়।
এর আগেও ‘বর্ণনাত্মক’ রীতিতে
নাট্যচর্চা হয়েছে বিশ্বব্যাপী, তবে
‘বাঙলা বর্ণনাত্মক রীতি’ বলতে যে
স্বকীয় নাট্যরীতিটি বর্তমানে প্রচলিত তা ‘দেশজ’ নাট্যরীতি নিয়ে যারা গবেষণা-নিরীক্ষা করছেন তাদের প্রচেষ্টাতেই
এদেশে শুরু হয়।
শুরুতে এই রীতিটিকে মানতেই
চাননি আমাদের শহুরে নাট্যজনেরা। কেননা,
তাঁরা এতে অভ্যস্ত ছিলেন
না। তবে
গত ২৫ বছরে রীতিটির
অনর্গল প্রয়োগের মাধ্যমে আজকাল অনেকেই রীতিটিকে
অন্তত স্বীকার করছেন। তবে
এই রীতিটির প্রতি প্রিয়তা তৈরি
হয়নি এখনো। প্রিয়তা
তৈরি না হওয়ার পেছনে
সেই অনভ্যস্ততা কিম্বা ঔপনিবেশিক নন্দনতত্ত্বের
প্রতাপ অবচেতনে ক্রিয়াশীল। ‘গাজীর
গানতো রিচুয়াল’, ‘পালাগানতো গান’ এই ধরনের
মন্তব্যের ঝড় দেখেছি আমরা
নব্বই দশক থেকে; মৌখিক
কিম্বা লিখিত আকারে, সেমিনারে
কিম্বা মহিলা সমিতি চত্বরে। আজকাল
অবশ্য কিছুটা কমেছে এই
ধরনের মন্তব্য। কেননা,
এই রীতির নাট্য প্রযোজনাগুলোর
অনেকগুলোই দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু
মুশকিলটা হলো এই রীতির
দার্শনিকতা অনুধাবন না করে অনেকেই
এর প্রয়োগ করছেন।
খানিকটা গান, খানিকটা নৃত্য,
দৃশ্য গ্রন্থনার জন্য কিছুটা বর্ণনা
প্রয়োগ করলেই বোধ হয়
বর্ণনাত্মক বাঙলা নাট্য হয়ে
গেলো - আর দেশজ রীতির নাট্যচর্চা
করে স্বকীয় হয়ে গেলাম
আমরা; বিষয়টা এমন! কিন্তু
ব্যাপারটা তা নয়, বাঙলা
বর্ণনাত্মক নাট্য রীতির স্বকীয়তাটাই
হলো এর বর্ণনাময়তায়।
গান-নৃত্য আর বর্ণনার
মিশেল হলেই ‘বাঙলা বর্ণনাত্মক
রীতি’ হয় না।
এই আঙ্গিকটি জীবনের এক নিজস্ব
ধরনের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে এক অদ্বৈত
মঞ্চভাষার মাধ্যমে। সেটা
সকলে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারছে না
বলেই এই রীতির তথাকথিত
‘দেশজ’ নাটকগুলো অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য
হচ্ছে না বলে অভিমত
করা যেতে পারে।
তাছাড়া এই রীতিতে অভিনেতার
যে পারদর্শিতা প্রয়োজন আজকালকার ‘আধুনিক’ ‘প্রয়োজনসর্বস্ব’, ‘ব্যস্ত’ মানুষদের মধ্যে সেই ধরনের
পারদর্শী অভিনেতা পাওয়া যাচ্ছে না
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। সে
কারণেই মঞ্চসফলতা পাওয়া মুশকিল হচ্ছে। একজন
ইসলামউদ্দিন বা একজন শিমূল
ইউসুফ দিয়ে এই সমাজে
একটি অনভ্যস্ত-অপরিচিত রীতির গ্রহণযোগ্যতা তৈরি
করা মুশকিল। বিশেষত
যে সমাজ ঔপনিবেশিক ভাবধারা
দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আছে সে
সমাজে তো বটেই।
আবার, ‘দেশজ’ নাট্যরীতির পক্ষে
যারা কথা বলছেন বা
কাজ করছেন তাদের মধ্যে
এক ধরনের ইউরোপ-বিরোধী
মনোভাব লক্ষ করা যায়
কখনো কখনো। মনে
রাখা প্রয়োজন, অ্যারিস্টটল, স্তানিস্লাভস্কি কিম্বা ব্রেখটের শিল্পরীতিটি
সারা দুনিয়াতে প্রতাপের সাথে বেঁচে আছে। এই
রীতিগুলোর দার্শনিকতা না থাকলে কালের
প্রবাহে তা হারিয়ে যেতো। যারা
দেশজ শিল্পরীতি নিয়ে কাজ করছেন
তাঁদের উচিৎ প্রতিষ্ঠিত শিল্পরীতিগুলো
অনুধাবন করে তার পাশাপাশি
নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসা। অবশ্যই
যদি তা প্রয়োজন হয়
তবেই। তা
না করে, ইউরোপীয় কিম্বা
সংস্কৃত নন্দনতত্ত্বের যারা অনুসারী তাঁদের
সমালোচনা কিম্বা তর্ক করতে
দেখা যায় কখনো কখনো। এতে
ঔদার্য্য নেই, এর মাধ্যমে
আমাদের শহুরে মঞ্চে বিদ্যমান
নান্দনিকতার দ্বন্দ্বের শেষ হবে না।
আরো একটা সমস্যাটা হলো
এই যে, যারা ইউরোপীয়
তথা ঔপনিবেশিক ভাবধারার অনুসারী তারা কিন্তু তাদের
ওরিয়েন্টেশনটাকে স্বীকার করছেন না।
কিন্তু ঘুরে ফিরে তাঁরা
যা করছেন তা স্পষ্টতই
বোঝা যাচ্ছে যে সেগুলো
ইউরোপীয় বা ঔপনিবেশিক নন্দনতত্ত্বের
অনুসারী, তাই কোনো অর্থেই
তা আমাদের সাংস্কৃতিক চিহ্ন-বহন করে না। উপরন্তু,
তারা কখনো কখনো ‘দেশজ’
রীতির স্বকীয়তাকেও ইউরোপীয় প্রভাবজাত বলে প্রমাণ করার
চেষ্টা করছেন কখনো কখনো। বাঙলা
নাট্যের গীতময়তাকে ইউরোপীয় অপেরার সঙ্গে মিলিয়ে
দেখা, ‘পালাগান’কে ‘ব্যালাড’ হিসেবে
অনুবাদ করা ইত্যাদি এই
প্রচেষ্টার দৃষ্টান্ত। আজকাল
আমাদের দেশের কেউ কেউ
আবার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ‘দেশজ
নাট্য রীতি’র প্রয়োগকারীদের
নাট্য প্রযোজনা সম্পর্কে এমন জায়গা থেকে
সমালোচনা করছেন যে, তা
ইউরোপীয় সমালোচনাতত্ত্বের মাপকাঠি দিয়ে করা হচ্ছে
বলে স্পষ্টই বোঝা যায়।
তা করাই স্বাভাবিক, কেননা
তাঁদের কাছে স্বীকৃত শাস্ত্র
আছে যা দিয়ে সমালোচনা
করাটা বেশ ‘নিরাপদ’ এবং
‘যৌক্তিক’। অন্যদিকে, ‘দেশজ
নাট্যরীতি’ নিয়ে যারা কাজ
করছেন তাঁদের কোনো শাস্ত্র
নেই, শিল্পসূত্র নেই অথচ তাঁরা
এই রীতিটি গ্রহণ করেছেন
এ দেশের ভূমি ও
ভূমিজাত জনরুচি থেকে।
কিন্তু তাঁরা এই রীতিটিকে
জনরুচিজাত হিসেবে জনপ্রিয় করে
তুলবার শিখড়ে এখনো নিয়ে
যেতে পারেননি। তাই
কখনো কখনো অবচেতন হতাশা
থেকেই হয়তো ইউরোপবিরোধী মনোভাব
ব্যক্ত করে ফেলছেন।
এর ফলে আমাদের ‘শিক্ষিত’
ও ‘শহুরে’ নাট্যচর্চার প্রাঙ্গণে
একটি দ্বন্দ্বমুখরতা টের পাওয়া যায়।
লেখকের
বিচারে উপরে উল্লেখিত দ্বন্দ্বটি
মঙ্গলজনক হবে তখনই যখন
তা শেষ পর্যন্ত নব
নব দৃষ্টিভঙ্গি অন্বেষণে আমাদেরকে অনুপ্রেরণা জোগাবে। আমরা
যদি বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন
থিয়েটারে স্বপ্ন দেখে পথ
চলি তবেই এই দ্বন্দ্ব
আমাদেরকে পথচলার নিয়ামক হিসেবে
শক্তি জোগাবে। আমাদের
প্রয়োজন এমন এক থিয়েটার-
যা দেশজ চিহ্নসহই বিশ্বজনীন ও আধুনিক।
তাই এটুকুই বলতে চাই
যে, এই দ্বন্দ্বমুখরতার মধ্যে
মানসিক ঔদার্য্য নিয়ে শিল্পচর্চার পথ
খুঁজতে হবে, কারণ দ্বান্দ্বিকতার
মধ্যেই জ্ঞানের প্রদীপ বিরাজমান- যা
আমাদের থিয়েটারের মুক্তি-তত্ত্বের সন্ধান
দেবে।
No comments
Thanks for your comment