সংগঠন, সভ্য ও থিয়েটার
সংগঠন, সভ্য ও থিয়েটার
রুদ্র প্রসাদ চক্রবর্তী
(পরিচালক – আসানসোল চর্যাপদ)
“সকলেই কবি নয়
কেউ কেউ
কবি"; জীবনানন্দ দাশ এই কথাটি
লিখেছিলেন তা নিশ্চিত সকলেরই জানা। আসলে
সবাই জীবনে
কখনও না
কখনও কবিতা
লেখেন।
সেভাবেই শিল্পচর্চা
করতে হয়তো
অনেকেই আসেন
এবং ভেবে
বসেন তা
বড়োই সহজ। শিল্পী
হতে কোনও
পরিশ্রমেরই প্রয়োজন পরেনা। মহলা
কক্ষ যেন
কোনও ক্লাব
ঘর, যেখানে
গিয়ে কিছুক্ষণ
গুলতানি মারা
যায়।
সংগঠনের সাথে
থাকলে পরিচিতি
বাড়ে।
সমাজে একটা
পরিচিতি পাওয়া
যায়।
সাংস্কৃতিক জগতের সাথে যুক্ত থেকে
একটা শিল্পী
শিল্পী ভাব
আনা সম্ভব
হয় মানুষের
ভিতরে।
আসলে বিষয়টি
কিন্তু তা নয়, কারণ শিল্প
অত সস্তা
বিষয় নয়,
যদিও সে
বিষয় আজ
থাক, অন্য
সময় তা
লেখা যাবে।
আর কোনও সংগঠনের
সভ্য হওয়া
সেটাও কিন্তু
খুব একটা
সহজ পদ্ধতি
নয়।
অর্থাৎ প্রকৃত
সভ্য বা
সদস্য হওয়ার
কথা বলছি। 'সভ্য',
এই শব্দটির
সাথে সম্মিলিত
শব্দ হলো
'সভ্যতা'।
যে কোন
সংগঠনের সদস্যদের
বলা হয়
সভ্য।
আর সভ্যতা
সামাজিকতার সঙ্গে যুক্ত।
একটি সংগঠনে একনিষ্ঠভাবে
থাকলে তবেই
তা বোঝা
সম্ভব।
তা না
হলে আপনি
শুধু বেঁচেই
থাকবেন নিজের
জন্য, সে
আপনি কোনও
সংগঠনের সদস্য
হন বা
না হন।
সংগঠন একটি ছোট্ট
দেশ,
একটি সমাজ। সেখানে আপনি
কিভাবে রয়েছেন,
সেই সংগঠনের
প্রতি আপনি
কতটা দায়িত্ববান
বা যত্নশীল,
তার উপরে
নির্ভর করে;
আপনি বৃহৎ
সমাজে বা
বৃহৎ সভ্যতায়
কিভাবে থাকবেন। "স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ"
হবেন নাকি
"সকলের তরে সকলের আমরা" তা
নির্ভর করে
এর উপরেই।
এই সূত্র ধরেই
আসি থিয়েটার
প্রসঙ্গে।
থিয়েটার মানেই
তার জন্য
প্রয়োজন একটি
একাত্মতার।
কিছু মানুষের
যৌথ প্রয়াস
হলো এক
একটি প্রযোজনা। সেই
থিয়েটার বা
সেই নাট্যদল
কি দিতে
পারে?
একটি ঘটনা বলি;
আমাদের দল চর্যাপদের
একটি
বছর বারো-তেরো ছেলের কথা। তাকে
আমি দোকান
থেকে একটি
জিনিস আনতে
বলেছিলাম।
সে তখন
ছোটোদের চর্যাপদের
আরও দুই
জন সমবয়সী
বন্ধুকে নিয়ে
জিনিসটি আনতে
যায়।
এসে টাকা ফেরৎ
দিতে গিয়ে
বলে
সে হিসেব করে দেখলো; দোকানদার
দশ টাকা
বেশি দিয়েছেন।
আমরা অনেকেই দশ
টাকা নিজের
পকেটে ঢুকিয়ে
নিয়ে, বাকি
টাকাটা হয়তো
ফেরৎ দেবো। আর
যখন তিনজন
বন্ধুই বিষয়টি
জানে তারা
ঐ টাকা
নিয়ে চকোলেট
কিনতে পারতো।
কিন্তু তারা তিনজনেই বলে; "দোকানদার
টাকা বেশি
দিয়েছে কি
করা যায়
ফেরৎ দিয়ে
আসব এখনই?
এখনই যাই?" আমি বলি; সকালবেলায়
গিয়ে ফেরত
দিতে।
সাথে বলি
"এই দশ
টাকাটা, দশ
হাজার হতে
পারত কিংবা
দশ লক্ষ,
এই টাকার
সংখ্যাটা যতই
বাড়ুক না
কেন, যেদিন
তুমি ওই
টাকাটা ফেরৎ
দেওয়ার কথা
ভাববে না,
সেদিন তোমার
শরীর বেঁচে
থাকবে ঠিকই
কিন্তু মনের
সবুজ পাতাগুলো
মরে যাবে,
সেদিন শরীর
বড়ো হবে
কিন্তু তুমি
আর বড়ো
হবেনা অর্থাৎ
তুমি মানসিক
ভাবে মৃত
হয়ে যাবে
সেদিন থেকে। তোমার
বেঁচে থাকার
অধিকারও চলে
যাবে।"
জানিনা সেদিন সে
কথাগুলো কতটা
বুঝলো, কিন্তু
নাট্যসংগঠন তার ভিতরে একটা বোধের
জন্ম দিয়েছে
সেটা নিশ্চিৎ।
বলছিলাম একটু আগেই,
সবাই শিল্পী
হতে পারেননা।
দশ জনের মধ্যে একজন শিল্পী
হন।
আসলে শিল্পী
দশ জনের
মধ্যে বাকি
নয় জনের
থেকে আলাদা
বলেই শিল্পী
হন। তার মানে কি
তিনি বাকি
নয় জনের
সঙ্গে সম্পর্ক
রাখবেন না? তিনি শিল্পচর্চা করেন
বলে কী
অন্য সকলে,
তার কাছে
ক্ষুদ্র! বিষয়টা
এভাবে ভাবলেই
ভুল।
শিল্প চর্চা
করে মহান
কিছু করলাম,
এই প্রবনতা
আমাদের আাসলে
সামাজ থেকে
দূরে করে
দেয়।
একজন রিকশাচালক
বা একজন
শিল্পী দুজনেই
তার কাজটা
করছেন।
দুজনের কাজটাই
সমাজের জন্য
প্রয়োজন।
এখন শিল্প দেখতে
আসছে সাধারণ
মানুষ, মানে
যারা ওই
দশ জনের
মধ্যে রয়েছেন। অর্থাৎ
বাকি নয়
জনের সঙ্গে
যোগাযোগ রাখতে
হবে নিয়মিত। তার
মধ্যে হয়তো
দুজন দেখতে
আসতে পারেন।
তবে কেনো বাকিরা
এলেন না?
কারন; আবার
ঐ 'সংগঠন'। আমরা
সংগঠিত করতে
পারিনা সাধারন
মানুষকে।
থিয়েটার দেখতে
আসেন সমাজের
তথাকথিত কিছু শিক্ষিত,
প্রতিষ্ঠিত মানুষ। কিন্তু অতি
সাধারন মানুষ
আসেননা।
রাস্তার চায়ের
দোকান বা
পানের গুমটির
ভদ্রলোকটি কিন্তু আসেননা। কারন
আমরা নিজেদের
সংগঠনটাই সঠিকভাবে
করতে পরিনি। সংগঠনের
সবাইকে নিয়ে
কাঁধে কাঁধ
মিলিয়ে চলার
ক্ষমতা আমাদের
নেই।
তাই সমাজের
সর্বস্তরকে নিয়ে আসতে পরিনা দর্শকাসনে
বা নাট্যদলে।
একটাই রাস্তা; আমাদের
শিল্প নিয়ে
পৌছে যেতে
হবে তাদের
কাছে।
দেখেছেন নিশ্চিত,
শাহরুখ খান
বা অমিতাভ
বচ্চনকেও তাদের
অভিনীত বা
প্রযোজিত চলচিত্রের
জন্য বিভিন্ন
অনুষ্ঠানগুলোতে প্রচারে আসতে টিভিতে।
মানুষের কাছে
পৌঁছাতে তারা
নানা ধরনের
প্রচারের ব্যবস্থা
করেন।
সেখানে থিয়েটারের
প্রচারের জন্য
আমরা কতটা
ভাবছি।
লেখাটি যেহেতু
সংগঠন কেন্দ্রীক,
তাই প্রচার
প্রসঙ্গে অন্য
সময় লেখার
অবকাশ রয়েছে। তবে
সংগঠনের জন্য
প্রচার ও
প্রসার দুই
প্রয়োজন।
প্রচার করতে
হবে মানুষের
কাছে পৌঁছানোর
তাগিদ অনুভব
করে।
যাতে আমাদের
কাজ নিয়ে
আমরা অনেক
বেশী মানুষকে
ভাবাতে পারি
বা আনন্দ
দিতে পারি
এবং প্রসার
করতে হবে;
নিজের জ্ঞানের,
চিন্তার শিল্প
সাধনার এবং
সততার। আসলে শিল্পী তারাই
হতে পারেন
যিনি একজন
প্রকৃত ভালোমানুষ। আর
তাদের নিয়েই
একটা ভালো
উন্নত সংগঠন
গঠন হতে
পারে।
যারা ভাল মানুষ
নন কিন্তু
দামী বা
নামী শিল্পী,
তাদেরকে আর
যে যাই
বলুক, আমি
মনে করি
তাদের মানুষের
সামনে দাঁড়িয়ে
থিয়েটারে বড় বড় বুকনি দেওয়ার
কোন অধিকার
নেই।
সেক্ষেত্রে একজন মিথ্যেবাদী রাজনৈতিক নেতার
সঙ্গে সেই
অভিনেতার কোন
পার্থক্য থাকে
না।
তাই প্রকৃত
বড়ো মন
নিয়েই সম্ভব
সংগঠনের প্রকৃত
সভ্য হওয়া। তাহলেই
সেই সংগঠন
প্রকৃতই ভালো
কাজের মাধ্যমে
মানুষের কাছে
পৌঁছতে পারবে।
তবে চারপাশে অনেক
পাঁক।
সেগুলো কাটিয়ে
উঠে দাঁড়াতে
সময় লাগবে
নিশ্চিৎ।
হয়তো সুফলটা
আমরা পাবোনা। কিন্তু
আগামী! তার
কথা ভেবেই
তো আমাদের
বৃহৎ সমাজ
নিয়ে এক
বৃহৎ সংগঠন
গঠনের প্রচেষ্টা
চালিয়ে যেতে
হবে।
আর তার
দ্বায়িত্ব অবশ্যই নিতে হবে থিয়েটারকে। কারন
থিয়েটার সমাজের
নিয়ে ভাবে। সমাজের
ছবি আঁকে। সমাজের
কথা বলে।
লিখতে গিয়ে দেখছি
এই লেখাটা
অনেকগুলো লেখার
বীজ বলতে
পরি, যার
থেকে অনেকগুলে
নতুন চারাগাছের
জন্ম হবে। আর
সেই সকল
চারাগাছ লেখার
মাধ্যমে তুলে
আনবো ভবিষ্যতে,
কথা দিলাম।
তা সে যাই
হোক,
শুরুটা জীবনানন্দ দাশকে
দিয়ে করেছিলাম,
শেষটাও তাকে
দিয়েই করি। যে
বোধের আজ
অভাব আমাদের
মধ্যে, সেই
বোধ জাগরিত
হোক আমাদের
মতো প্রতিজন
শিল্পীর।
"আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্
এক বোধ
কাজ করে;
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক
বোধ জন্ম
লয়"
No comments
Thanks for your comment